Flickr Gallery

Sunday, October 6, 2013

মহাভারতের খানাপিনাঃ রান্নার মেশিন


সে আমলে যে যেমন তেমন করে রান্না হত তা নয়। পাচককে এখনকার শেফের মতোই পড়াশোনা করতে হত এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিজ্ঞ হতে হত। শুচি, দক্ষ, লোভশূন্য, চিকিৎসাশাস্ত্রভিজ্ঞ, পাকশাস্ত্রতত্ত্বজ্ঞ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিরাই পাকশালের কাজে নিযুক্ত হতে পারত। একাজ যেমন তেমন লোকের দ্বারা সম্ভব ছিলনা।

চেদি নগরে বাহুক নামে এক রাজপুরুষ ছিলেন। তিনি সুপ্রণালীক্রমে ভোজন সামগ্রী উত্তমরূপে তৈরি করতে পারতেন। অবশ্যই তিনি পেশাদার রাঁধুনি ছিলেন না। ভীম একবছর বিরাটরাজার পাকশালায় পেশাদার পাচক সেজে আত্মগোপন করেছিলেন।

গয় রাজা একবার প্রচুরান্ন যজ্ঞ করেছিলেন। কবিরা বলেছেন, ওই যজ্ঞে অন্নের প্রচুর পাহাড় ও ঘিয়ের পুকুর তৈরি করা হয়েছিল। এ ছাড়াও দইয়ের শত শত নদী ও নানারকম ব্যঞ্জনপ্রবাহ ওই যজ্ঞে প্রবাহিত হয়েছিল। ব্রাহ্মণ ছাড়াও অন্যান্য লোকেরা ওই অন্ন ও নানারকম ব্যঞ্জন ভোজন করেছিলেন। মানুষেরা রকমারি খাবার খেয়ে এতই তৃপ্তি পেয়েছিলেন যে তাঁদের খুশি তাঁরা গান গেয়ে জাহির করতেন। এত লোকে এত কিছু খেয়েও রাজার খাদ্যভান্ডার একটুকুও কমাতে পারেননি। তাই তাঁরা ঢাক ঢোল পিটিয়ে গ্রামে গঞ্জে ঘুরে অন্যান্য নাগরিকদের বলে বেড়াতেন, রাজার যজ্ঞে এখনও পঁচিশ পাহাড় ভাত জমে আছে। কোনও ভোজনরসিক থাকলে তিনি যেন গিয়ে খেয়ে আসেন।

পাচক রান্না করতেন। আবার পৌরাণিক কবিদের কাব্যে একটি মেশিনের মতো কিছু একটার বর্ণনা পাওয়া যায়। বলা যায় অটোমেটিক কুকিং মেশিন। মাইক্রোওভেন বাজারে এলেও এমনধারা রান্নার মেশিন এখনও আমরা দেখতে পাইনা। সেই যন্ত্রের মধ্যে কিছু না দিয়েই রান্না করা হত। এমনই এক যন্ত্র ছিল রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে। যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় হেরে যাওয়ার পর শর্ত অনুযায়ী পাঁচ ভাই আর দ্রৌপদীকে অনেক বছর বনবাসে থাকতে হয়েছিল। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বনে যাওয়ার জন্যে ওই দেশের ব্রাহ্মণরা ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাছোড়বান্দা ব্রাহ্মণকূল যুধিষ্ঠিরের সঙ্গেই বনে গিয়েছিলেন। বনযাত্রীর লিস্ট কাটছাঁট করে একদল ব্রাহ্মণকে নিয়ে বনে ঢুকে যুধিষ্ঠিরের মনে পড়ে, এত বনযাত্রীর জন্যে তাঁর কাছে রসদ নেই। রাঁধুনিও নেই। এত মানুষ খাবে কি! এত লোকের দীর্ঘদিনের ভরণপোষণের জন্যে অর্থ আসবে কোথা থেকে? খাদ্যসামগ্রী আসবে কোথা থেকে! কোথায় পাওয়া যাবে এত লোকের অন্ন! বড়ই চিন্তায় পড়লেন যুধিষ্ঠির। বনবাসে এসেও সংসারধর্ম করতে হলে বনবাসের মর্যাদা হানি হবে। দুর্যোধনও বলার সু্যোগ পেয়ে যাবেন। একবার বনবাস ঠিকঠাক না হলে আবার বারো বছরের সশ্রম বনবাস। যুধিষ্ঠিরকে চিন্তিত দেখে মুশকিল আসান করতে শৌনক ঋষি আবির্ভূত হলেন। বনযাত্রী ব্রাহ্মণকূলও নিজেদের খাদ্য নিজেরা সংগ্রহ করবেন বলে ইচ্ছে প্রকাশ করে রাজা যুধিষ্ঠিরকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে বললেন। ফলমূল, কাঠকুটো কুড়িয়ে নিয়ে আসবেন ব্রাহ্মণরা। তারপর না হয় তাই সবাই মিলে খাওয়া হবে। কিন্তু যুধিষ্ঠির ছিলেন জাতে ক্ষত্রিয়। ব্রাহ্মণরা তাঁর কাছে আশ্রিত। ব্রাহ্মনোদের উপার্জিত খাদ্যদ্রব্যে ভাগীদার হতে তাঁর বিবেকে বাধল। তিনি ব্রাহ্মণদের পরামর্শে সায় দিতে পারলেন না। ওদিকে শৌনক যুধিষ্ঠিরকে পরামর্শ দিলেন সূর্যের উপাসনা করতে। সূর্যই পারবেন এ সমস্যার সমাধান করতে। অন্নের উৎপাদক সূর্য। তিনি না চাইলে পৃথিবীতে একটা ঘাসও গজাত না। সমস্ত অন্নের কধ্যেই তাঁর শক্তি নিহিত। সাধারণ মানুষের তো আর বালখিল্য ঋষিদের মতো সূর্যের শক্তি প্রত্যক্ষ ভাবে আহরণ করা সম্ভব নয়। তাই তিনি খাদ্য শষ্যের মধ্যে তাঁর শক্তি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ওসব খেলেই মানুষের শরীরে শক্তি সঞ্চারিত হয়। ষোউনকের পরামর্শে যুধিষ্ঠির প্রাণপণে সূর্যকে ডাকতে আরম্ভ করলেন। সূর্যদেবকে খুশি করার জন্যে স্তব শুরু করলেন। তাঁর একশো আটটা নাম ধরে ডাকাডাকির চোট সূর্যদেব শুনতে পেলেন। 

যুধিষ্ঠিরের সমস্যার কথা সুনে সূর্যদেব তাঁকে একটা তামার থালা দিয়েছিলেন। রকমারি রান্না করতে পারত এই যন্ত্রটি। অল্প পরিমাণ চাল ডাল আলু পেঁয়াজ এর ওপর রেখে দিলে অফুরন্ত খাবার তৈরি হত। যতক্ষণ না দ্রৌপদীর খাওয়া হত, ওই যন্ত্র থেকে খাবার পাওয়া যেত। অক্ষয়স্থালী নামের ওই যন্ত্রটি হয়তো সোলার কুকার জাতীয় কিছু ছিল। কিংবা তার চেয়েও বড় কিছু! কবিদের কল্পনারও বলিহারি! রাঁধুনি নেই, অর্থ নেই, অন্ন নেই, তবু যুধিষ্ঠির আর তাঁর সঙ্গীরা যন্ত্রের তৈরি খাবার খেয়ে বনবাসে রয়ে গেলেন।

স্বয়ংক্রিয় রান্নার যন্ত্র যেমন ছিল তেমনি আবার পাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠ রাখার জন্যেও লোকজন ছিলেন। হৃদয় নামক অগ্নির পুত্র মন্যুমান। মন্যুমান অগ্নি জঠরে বসে ভূক্ত দ্রব্যের পরিপাক পক্রিয়া সমাধা করতেন। পেট বিরাট এক গহ্বর। সেখানে জঠরাগ্নি জ্বলতে থাকেন। মানুষের যাবতীয় ভূক্ত জঠরাগ্নি পাচন করতেন।
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...
বাংলা ব্লগ জগতের সিন্ধুতে আমরাও একটা বিন্দু। নেট ঘেঁটো বাঙালির আপ্যায়ণে বড় হচ্ছে। শৌভিকের লেখা পড়তে এই ব্লগে যান LEKHASHAUBHIK.BLOGSPOT.COM